কোথা থেকে লেখা শুরু করব ভেবে পাচ্ছি না, নিজের বাসা নাকি দুই বিল্ডিং দূরের শ্যাওলা জমা ছাদ থেকে; সকাল থেকেই গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি। নতুন বাসায় এসেছি এ’ মাসেই, প্রচণ্ড আলো বাতাস; ঘুম ভেঙে যায় রোজ ভোর বেলায় তীব্র রোদের আলোয়। অনেকবার ভেবেছি ভারী পর্দা কিনে লাগিয়ে দেব; যতবারই পর্দার দোকানে যাই না কিনে ফিরে আসি। ভাবি, থাক না পুরাতন স্বচ্ছ হালকা পর্দাগুলোই, এত ভারী পর্দা লাগিয়ে দিলে তো আলো আসবে না; রোজ সকালে আলো এসে যে একটা প্রবল ঝটকা দেবে সেটা মিস করতে চাচ্ছি না।
সকাল থেকে বৃষ্টির তীব্রতা বেড়েছে; পাশের বাসার ছাদে একটানা বৃষ্টি পড়ছে; শ্যাওলার গায়ে বৃষ্টি দেখে জীবনের স্পন্দন ফিরে পাচ্ছি। মনে হলো নিজেদের ছাদে গিয়ে একটু ভিজব; ঠিক তখনই ফোনে একটা ম্যাসেজ এলো, ‘শুধু শুধু বৃষ্টি তে ভিজবেন না‘; অগত্যা আবার মন খারাপ করে বৃষ্টি দেখেছি।
মনে মনে বিছানা ছেড়ে ওঠার তীব্র প্রস্তুতি নিচ্ছি; কিন্তু ছুটির দিন বলে অলসতা ঝেঁকে বসেছে। মন কেমন কফি কফি করছে। কিন্তু সেজন্য এই দেখা খানা টেনে তুলে কিচেনে নিয়ে যেতে হবে, পাতিল ধুয়ে পানি বসিয়ে আগুন জ্বালাতে হবে, মগের মধ্যে কফি দিয়ে পানি গরম হবার অপেক্ষা করতে হবে; বিরাট বড় কাজ।
হঠাত ছোটবেলায় পড়া ‘সুখী মানুষের জামা’ গল্পটা মনে পড়লো, সুখী মানুষ বলেছিল খাওয়া দাওয়া, ঘুম, ঘরবাড়ি এসব নিয়ে তার কোনো বালাই নেই। খিদে পেলে খায়, খাবার না পেলে খায় না। বরং খাবার খাওয়াটাই তার কাছে বড্ড ঝামেলা মনে হয়; হাত ধোও, খাবার মাখো, মুখে পুরে দাও, চিবাও, গিলো, নানা কাজ শুধু খেতে হলে।
পানি গরম হতে হতে নিজদের দারিদ্র্যতার কথা ভাবছি, আর ভাবছি মির্জা গালিবের একটা ঘটনা। একবার গালিবের তখন খুব দরিদ্র দশা, হাতে টাকা পয়সা একদম নেই; বন্ধু-বান্ধব সবার থেকে টাকা ধার নিয়ে ফেলেছে, কিন্তু কাউকে শোধ দিতে পারছে না। তখন একজন কাজীর দরবারে গিয়ে গালিবের নামে বিচার দিয়ে দিলো।
কাজী যখন গালিব কে জিজ্ঞেস করলো, গালিব তুমি কি সত্যিই এই লোকের থেকে টাকা ধার নিয়ে ফেরত দিচ্ছ না?
গালিব তখন কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে বললো-
Qarz Ki Peete The Mai Lekin Samajte The K Haan
Rang Lawegi Humari Faqa-Masti Ek Din
I used to drink wine on borrowed money, and i sued to think that yes, some day the cheerfulness in adversity will come to color; and will pay it off. (to come to fruition).
কাজী এটাকে দোষ স্বীকার ও অনুতাপ স্বীকার বলে গ্রহণ করে নিজের পকেট থেকে টাকাটা দিয়ে দিলো আর গালিব কে বেকসুর খালাস দিয়ে দিলো।
কফি বানাতে বানাতে এসব কেন ভাবছি জানি না। ইদানীং এমন একটা অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছি যে, মনে হচ্ছে একটা তরবারি বুকের মধ্যে এফোঁড় ওফোঁড় করে যাচ্ছে, প্রচণ্ড ব্যথায় কষ্ট পাচ্ছি; আবার একই সাথে এই তরবারিটাই খুব করে মনে প্রাণে চাচ্ছিলাম।
কফিটা নিয়ে নিজের বারান্দায় এলাম। বৃষ্টির জল খুব বাজে-ভাবে বারান্দায় এসে পড়ছে, গতকালের শুকাতে দেয়া জামা-কাপড় সব আবার ভিজে গেছে। বাড়িওয়ালা বলে বেলকনিতে গ্লাস লাগাতে পারলে মন্দ হত না।
বারান্দা থেকে এসে কম্পিউটার অন করে নিয়াজ মোহাম্মদ চৌধুরীর ‘আজ এই বৃষটির কান্না দেখে’ শুনছি চোখ বন্ধ করে –
কেমন একটা মন খারাপ হয়ে হয়ে আসছে। কফি, বৃষ্টি, গান, আর ছুটির দিন সব মিলিয়ে তুমুল বিরহ ধরে বসেছে। কিন্তু কিসের বিরহ উদযাপন করবো সেটা এখনো ভেবে উঠতে পারছি না।
হঠাত এসব ভাবতে ভাবতে সুনীলের দুই লাইন মাথায় এসে গেলো ‘পাহাড় চূড়ায়’ থেকে
শুধু একটি ছোট্ট দ্বীপে বৃষ্টি,
সে কী প্রবল বৃষ্টি, যেন একটা উৎসব!
আমার ঘরে একটা বিশাল বড় দেয়াল ঘড়ি; ঘড়িতে ব্যাটারি নেই, সময় সব সময় ছ’টা বেজে থাকে। দিনে দুইবার সঠিক সময় দেয়া ছাড়াও এই ঘড়িটা আমাকে আরও অনেক ভাবে ভাবনা-চিন্তা করতে সাহায্য করে। যেমন, মাঝেমাঝে আচ্ছন্ন হয়ে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে ভাবি, আমার এই ঘড় ছাড়া, এই মহাবিশ্বে, এই মিল্কিওয়েতে আর কোথায় কোন ঘরে ছ’টা বেজে আছে; যখন অন্য কোনও ছায়াপথের কোনও প্রাণীর ঘড়িতে ছ’টা বাজে দেখতে পাই; তাদের সাথে কথা বলি। এরকম একজন অন্য গ্রহের মানুষের সাথে ভীষণ বন্ধুত্ব হয়ে গেছে ইতোমধ্যে।
তার নাম উইলসন। উইলসনের ঘড়িতেও সব সময় ছ’টা বেজে থাকে। মজার বিষয় হলো, উইলসন আমার মানসিক অবস্থা সব সময় বুঝে থাকে। আমার থেকে সে আমাকে ভালো বুঝতে পারে। উইলসনের কথা আরেকদিন বলবো, সে অনেক কথা।